পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর শব্দ ‘মা। মাতৃত্বে রয়েছে একজন নারীর পূর্ণতা। নারীর সারা চেতন জুড়ে মাতৃত্বের আকাঙ্খা থাকে। নিরাপদ মাতৃত্ব একটি মানবাধিকার। সেজন্য নিরাপদ প্রসব একজন মায়ের অধিকার। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় প্রসূতিকে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে ও রাখতে হবে। সেজন্য হাসপাতাল, ক্লিনিক, স্বাস্থকেন্দ্রে মাতৃসেবা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
সন্তান জন্মের পর শিশুর প্রথম খাবার মায়ের বুকের শালদুধ। মায়ের প্রথম আদরের মতো এই শালদুধ শিশুর জন্য জন্ম টিকা। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে নবজাতক শিশুর জন্য মায়ের আদর শিশুর রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। জন্মের পর শিশুর পুষ্টি ও যত্নের দিকে মা এতোটাই নিমগ্ন থাকেন যে, মা নিজের যত্ন নিতেও ভুলে যান। নানারকম স্বাস্থ্যসমস্যা এ সময়ে দেখা দিতে পারে। কোনো কোনো সময় সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে অনেক মায়ের মৃত্যুও হতে পারে।
শিশুর জন্মের পর পূর্ণ ছয় মাস পর্যন্ত বুকের দুধ ছাড়া অন্য কোনো খাবারের প্রয়োজন নেই। এমনকি পানিরও প্রয়োজন নেই। ছয় মাস অর্থাৎ ১৮০ দিন পর থেকে দুই বছর বয়স পর্যন্ত পরিপূরক খাবারের পাশাপাশি মায়ের বুকের দুধই শিশুর জন্য উৎকৃষ্ট, বিশুদ্ধ, নিরাপদ ও রোগ প্রতিরোধকারী খাদ্য। মায়ের দুধে শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় সব খাদ্য উপাদান বর্তমান। যা মায়ের প্রতিদিনের খাবার অথবা শরীরে সঞ্চিত পুষ্টি উপাদান থেকে সরবরাহ হয়ে থাকে। তাই এ সময় মাকে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে একটু বেশি পরিমাণে পুষ্টির প্রয়োজন। ল্যাকটোজ, ক্যালসিয়াাম, জিংক, আয়রন, কপার, ফোলেট ইত্যাদি পুষ্টি উপাদান মায়ের শরীরে ঘাটতি করে হলেও বুকের দুধে সরবরাহিত হয়। মায়ের শরীরে যদি আয়োডিন, ভিটামিন এ, সেলেনিয়াম ও বি-ভিটামিনগুলোর ঘাটতি থাকে, তাহলে বুকের দুধেও এগুলোর অভাব দেখা দেয়। স্তন্যদানকারী মায়ের অপুষ্টি রোধে এবং বুকের দুধের গুণগত মান অক্ষুন্ন রাখতে কিছু বিষয়ের প্রতি নজর দেয়া জরুরি:
- প্রতিবার শিশুকে বুকের দুধ দেওয়ার আগে মা এক থেকে দুই গ্লাস পানি বা তরলজাতীয় খাবার খাওয়া উচিত। যেমন দুধ, স্যুপ, ফলের রস, রসালো ফল ও পানিসমৃদ্ধ সবজি খেলে বুকের দুধের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
- দুধে দুধ তৈরি হয়। প্রতিদিন দুধ বা দুগ্ধজাতীয় খাবার এ কারণে বেশি খাওয়ার প্রয়োজন। অন্তত আধা লিটার দুধ খাওয়া ভালো। ডিম, মাছ, মাংস, ডাল বা ডালজাতীয়, লইট্টা মাছ উচ্চ জৈবমূল্যের প্রোটিন। এগুলোতে আরো রয়েছে অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি অ্যাসিড, ক্যালসিয়াম এবং বি-ভিটামিন।
- গর্ভাবস্থা থেকে স্তন্যদানকালে মায়ের ও শিশুর ভিটামিন ডি-র অভাব হতে পারে। ভিটামিন ডি-র জন্য মা ও শিশু দুজনই প্রতিদিন সহনীয় অর্থাৎ কোমল রোদের আলোতে ১০ থেকে ১৫ মিনিট থাকা জরুরি। জন্মের পর অনেক সময় নবজাতকের জন্ডিস হতে দেখা যায়। নবজাতকের জন্ডিস প্রতিরোধে মায়ের পর্যাপ্ত বুকের দুধ ও সূর্যের আলো দেহে লাগানোই উত্তম। জন্ডিস হয়ে গেলে সূর্যের আলো লাগানোর সময়সীমা স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বাড়ানো দরকার। সূর্যের আলোর পাশাপাশি বুকের দুধ এমন পরিমাণে খাওয়ানো উচিত যেনো নবজাতকের পেট সর্বদা ভরা থাকে। নবজাতকের পাকস্থলীর ধারণ ক্ষমতা খুবই কম। কিছুক্ষণ পর পর সেজন্য বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। চিত করে শুইয়ে দিলে নবজাতকের পেট যেনো না ডেবে যায় তা খেয়াল রাখতে হবে। ডেবে গেলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন।
- প্রতিদিন গাঢ় সবুজ ও রঙিন শাকসবজি এবং মৌসুমি ফল খেলে প্রচুর আঁশ ছাড়াও ক্যালসিয়াম, আয়রন, বিটা ক্যারোটিন, ভিটামিন সি, ফোলেট ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট পাওয়া যায়। যা মায়ের দুধ তৈরি ও মায়ের দেহের ক্ষয় পূরণে বিশেষ সহায়ক। মায়ের খাদ্যে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি হলে মায়ের হাড়ের ক্যালসিয়াম দুধের ক্যালসিয়াম তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ফলে মা অসুস্থ হতে পারেন। মায়েদের খাবারে তা-ই প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়ামজাত খাবার রাখা উচিত। ৮৫০ মিলিলিটার মায়ের দুধে ৩০০ মাইক্রোগ্রাম রেটিনল বা ভিটামিন এ থাকে। তাই প্রতিদিন অতিরিক্ত ৩০০ মিলিগ্রাম ভিটামিন এ মায়ের খাদ্যে রাখা প্রয়োজন।
- শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ অব্যাহত রাখতে আয়োডিনযুক্ত লবণ মা-কে খেতে হবে। আয়োডিন তাপে-আলোতে-বাতাসে নষ্ট হয়। সারাজীবনের জন্য আয়োডিনের চাহিদা মাত্র ১ চা চামচ। বিভিন্নভাবে নষ্ট হওয়ার কারণে সালাদের সঙ্গে বা ফ্রুট-ককটেলের সঙ্গে আয়োডিনযুক্ত লবণ খাওয়া উচিত।
- অতিরিক্ত তেলে ভাজা ও মসলাযুক্ত খাবার না খাওয়াই ভালো। মায়ের দুধ তৈরিতে তেলে ভাজা খাবার খুব বেশি কাজ করে না। শিশুর জন্য প্রতিদিনের দুধ তৈরিতে American College of Obstetricians and Gynecologists (ACOG) মতে মায়ের প্রায় ৪৫০-৫০০ কিলোক্যালরির প্রয়োজন হয়। ক্যালরি পেতে স্বাস্থ্যকর তেল বা চর্বি প্রয়োজন হয়। যেমন: দুধ, দই, বিভিন্ন জাতের বাদাম, ঘি ইত্যাদি।
- খাদ্যবাহিত রোগের সংক্রমণ এড়াতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা ও স্বাস্থ্যবিধি চলা প্রয়োজন। দুধ, ডিম, মাছ, মাংস ভালো করে রান্না করে খেতে হবে। আধা সিদ্ধ খাবার না খাওয়াই ভালো। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ধরনের সাপ্লিমেন্ট ও ওষুধ একেবারে খাওয়া যাবে না।
- পর্যাপ্ত ঘুম স্তন্যদাত্রী মায়ের জন্য খুব প্রয়োজন। বেশিরভাগ দেখা যায়, শিশুর কাছ থেকে মা চলে গেলেই ঘুমন্ত শিশুও জেগে ওঠে। পর্যাপ্ত ঘুমের জন্য শিশু ঘুমানোর পর মায়ের ব্যবহৃত কাপড় শিশুর মাথার পাশে রেখে দেয়া প্রয়োজন। এতে শিশু তার মায়ের গন্ধ পায়। শিশুর কাছে তখন মনে হয়, মা তার পাশেই রয়েছে। অনেক সময় শিশুরা রাতে জেগে থাকে বা দেরিতে ঘুমায়। মায়ের ঘুম কম হওয়ার এটা আরেকটা কারণ। রাত ৮টার পর থেকে শিশুকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করুন। এর পাশাপাশি রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাতি কমিয়ে দিন। এ পদ্ধতিতে রাতজাগা শিশুদের রাতে ঘুমাতে সমস্যা হয় না। মায়েরও পর্যাপ্ত ঘুম হয়। অনেক সময় শিশুরা সারারাত কান্না করে। এ সমস্যার কারণ অজানা। রাতে শিশুদের গ্যাস হলে কুট কুট করে পেট ব্যথা করতে পারে। এ অবস্থা দূর করতে মা বা বাবা আধা শোয়া অবস্থায় শিশুকে উপোড় করে বুকে বা উরুর উপর পেটে সামান্য চাপ দিয়ে রাখলে এ ধরণের সমস্যা অনেকাংশে কমানো সম্ভব। নাভীতে যেনো চাপ না লাগে সেটা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।
স্তন্যদানকালে নিজের সন্তানের জন্য মায়েরা অনেক আত্মত্যাগ করে থাকেন। যেমন নবজাতকের খাবারে সমস্যা যেনো না হয় সেজন্য মায়ের ইচ্ছার বিরূদ্ধেও অনেক খাবার খেয়ে থাকেন। খুব ইচ্ছা হলেও যখন-তখন বাইরে যেতে পারেন না। বাইরে গেলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফিরে আসতে হয়। সময় ম্যানেজমেন্ট বা ব্যবস্থাপনা কঠিন হয়ে যায়। শখের বিষয়গুলোতে ঠিকমত সময় দিতে পারেন না। স্বামীকেও সময় দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। কর্মজীবিদের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজে যোগদানের প্রস্তুতিও নিতে হয়। সন্তানের দেখাশুনার জন্য বিশ্বাসী মানুষের অভাবে কখনো কখনো মা-কে হয়তো কর্মজীবন ত্যাগ করতে হয়। অনেক বেশি মানসিক সমস্যায়ও তখন মা ভুগতে পারেন। পরবর্তীতে যা ডিপ্রেশনে রূপ নিতে পারে। প্রসব পরবর্তী ডিপ্রেশন যেনো মায়ের না হয়, তা-ই পরিবারের প্রতিটি সদস্যের এই নতুন মায়ের প্রতি যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন।
সৈয়দা শারমিন আক্তার
প্রধান পুষ্টিবিদ, ডায়েট কাউন্সেলিং সেন্টার
If you have any queries please contact us
Please fill out the below details if you wish to receive a confidential call from our client relations team.