এখনকার শিশুদের মধ্যে ফাস্টফুড গ্রহণ যেন একটা ফ্যাশনের পর্যায়ে চলে এসেছে। বেশি দামের ফাস্টফুডের নাম বা ফাস্টফুডের দোকানের নাম বলাই যেন আভিজাত্যের প্রকাশ। এগুলো বড় ভুল। বর্তমানে অতিরিক্ত ফাস্টফুড গ্রহণের ফলে চাইল্ড ওবেসিটি বেড়েছে অনেক গুণ। কারণ টেস্ট বাড়ানোর জন্য ফাস্টফুডে যে বিভিন্ন ধরনের লবণের ব্যবহার করা হয় সেগুলো পরপর ৩ দিনও যদি কোনো শিশু খায় তাহলে শিশুদের মধ্যে এক ধরনের আসক্তির জন্ম দেয়। যে কোনো আসক্তিই ক্ষতিকর। আর তা যদি ফাস্টফুড হয় তাহলে তো কথাই নেই। কারণ এসব সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড, লবণ, বিভিন্ন ধরনের টেস্ট তৈরির উপাদানে পুষ্টিগুণ অনেক কম। ফলে এ ধরনের খাবারে আসক্তি বাড়ালেও অন্যান্য খাবারের রুচি কমিয়ে দেয়। ফলে শিশু দুধ, ডিম, শাকসবজির মতো পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে চায় না। ফলে তাদের মধ্যে অপুষ্টি সমস্যা দেখা দেয়। তাই শিশুদের যদি ছোটবেলা থেকেই ঘরে তৈরি খাবারে অভ্যস্ত করানো যায় এবং ফাস্টফুডের অপকারিতা বোঝানো যায় তাহলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। প্রতিনিয়ত ফাস্টফুডের অভ্যাস কখনই গ্রহণযোগ্য নয়।
ফাস্টফুডের উপর ভিত্তি করে শিশু-কিশোরদের মধ্যে জরিপের ফলাফল
সম্প্রতি দেশে প্রথম শিশু-কিশোরদের উপর ফাস্টফুডের প্রভাবÑ এমন জরিপ চালানো হয়। জাতীয় জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সহায়তায় আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) সাতটি সিটি করপোরেশনে এই জরিপ করেছে।
জরিপে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, রংপুর ও বরিশাল সিটি করপোরেশনের ২০৭টি ওয়ার্ডের ৫-১৮ বছর বয়সী ৪১০০ শিশু এবং তাদের মায়েদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। জরিপটি হয় ১ মে, ২০১৩ পর্যন্ত। শিশুশহরাঞ্চলে ১০ শতাংশ শিশু অতিরিক্ত ওজনের শিকার এবং ৪ শতাংশ শিশু স্থুলতায় ভুগছে। ঢাকা মহানগরে তা যথাক্রমে ১৪ শতাংশ ও ৭ শতাংশ। ঢাকাতেই এই হার সবচেয়ে বেশি। সবচেয়ে কম রংপুরে, সেখানে অতিরিক্ত ওজন ও স্থূল শিশু যথাক্রমে ৬ শতাংশ ও ১ শতাংশ। অতিরিক্ত ওজন ও স্থূল শিশুদের ৭০ শতাংশের বয়স ৫ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। বাকি ৩০ শতাংশের বয়স ১৩ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। তবে অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতা ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে সমান। শিক্ষিত পরিবারে অতিরিক্ত ওজন ও স্থুল শিশুর সংখ্যাই বেশি। এই সমস্যা মা-বাবা দশম শ্রেণির বেশি পড়াশোনা করেছেন এমন পরিবারের চেয়ে পঞ্চম শ্রেণির কম পড়াশোনা করা পরিবারে কম।
জরিপের প্রাপ্ত ফলাফল থেকে নিম্নের স্বাস্থ্যগত সমস্য প্রকাশ পায়:
শহরাঞ্চল:
ঢাকা মহানগরে ২১% শিশু-কিশোর স্থুল এবং এদের শারীরিক সক্রিয়তা কম। উচ্চ আয়ের ২০% পরিবারের ৪৪% শিশুই স্থুল। নিম্ন আয়ের ২০% পরিবারের ৪% স্থুল।
কারণ:
খেলাধুলা: শিশুরা দিনে বা সপ্তাহে ফুটবল বা ভলিবল খেলার মতো শারীরিক পরিশ্রম কম করে। ৭০% শিশুর স্কুলে বা বাড়ির আশপাশে খেলার মাঠে যায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৯৪% শিশুর শারীরিক প্রশিক্ষণের ক্লাস আছে। কিন্তু তাতে অংশ নেয় ৬২% শিশু।
খাদ্যাভ্যাস: জরিপের অন্তর্ভুক্ত অর্ধেকের বেশি শিশু সপ্তাহে তিন থেকে চারবার সিঙ্গাড়া, সমুচা, চপ, বেগুনি, পেঁয়াজু জাতীয় তেলে ভাজা স্ন্যাকস খায়। ২০% শিশু সপ্তাহে গড়ে একবার পিৎজা,বারগার, ফ্রাইডচিকেন বা এ ধরনের ফাস্টফুড খায়।
গ্রামাঞ্চল:
উল্লেখিত জরিপে গ্রামের কোন তথ্য উল্লেখ না থাকলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জরিপে দেখা গেছে গ্রামে শিশু-কিশোরদের মধ্যে ৩% স্থূলতার শিকার।
স্থূলতায় স্বাস্থ্যগত সমস্যা: অনেকেরই কর্মক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন। হৃদরোগ ও উচ্চরক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ছে, স্ট্রোকের মতো ঘটনাও ঘটছে। এমনকি হেপাটাইটিস ও বাত হচ্ছে।
প্রতিরোধ এবং প্রতিকারের উপায়: স্থূলতা প্রতিরোধে লাইফস্টাইলের সাথে ফুড হ্যাবিটের সামঞ্জস্যতাই একমাত্র পথ। অতিরিক্ত সময় ধরে টিভি কিংবা ভিডিও গেইমস না খেলা। শিশু-কিশোরদের খোলা মাঠে খেলতে উৎসাহিত করা। আশেপাশের পার্কগুলোতে হাঁটার অভ্যাস করা। তাছাড়া শিশু জন্মের ১ ঘণ্টার মধ্যে শালদুধ দেয়া এবং পূর্ণ ৬ মাস বয়স পর্যন্ত শুধুমাত্র মায়ের দুধ খাওয়ানোতে উৎসাহিত করা। বাড়তি খাবার দেবার সময় ঘরে তৈরি খাবারে অভ্যস্ত করানো। স্কুলের টিফিন-ঘরে তৈরি টিফিন স্বাস্থ্যসম্মত। তেল, চর্বি ও অতিরিক্ত মাংস ও কার্বোহাইড্রেটযুক্ত (ফাস্টফুড) খাবার থেকে শিশুদের দূরে রাখা।