ডেঙ্গুজ্বরে খাদ্যাভ্যাস
ডেঙ্গু যা ইংরেজিতে বলা হয় DENGEE। ডেঙ্গুজ্বর একটি মশা বাহিত ভাইরাল রোগ। যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। ডেঙ্গু ভাইরাস প্রধানত এডিস প্রজাতির নারী মশার দ্বারা সৃষ্ট। এই মশা চিকুনগুনিয়া, হলুদ জ্বর এবং জিকা ভাইরাসের ভেক্টর হিসেবেও চিহ্নিত। ডেঙ্গু গ্রীষ্মকালে বেশি বিস্তার লাভ করে। তাছাড়া বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, আপেক্ষিক আর্দ্রতা এবং অপরিকল্পিত দ্রুত নগরায়ণ জমে থাকা পানির কারণে বিস্তার সহজ করে তোলে।
প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী আনুমানিক ৪০০ মিলিয়ন ডেঙ্গু সংক্রমণ ঘটে। যার মধ্যে প্রায় ৯৬ মিলিয়নের বেশি অসুস্থ হয়। বিশ্বের গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে বেশি হয়ে থাকে। ঝুঁকিতে রয়েছে যেসব অঞ্চল সেগুলো হলো-
বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ চীন, তাইওয়ান, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ, ক্যারিবিয়ান (কিউবা এবং কেম্যান দ্বীপপুঞ্জ ছাড়া), মেক্সিকো, আফ্রিকা, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা (চিলি, প্যারাগুয়ে এবং আর্জেন্টিনা বাদে)
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ
ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমিত হয় এডিস মশার কামড়ে। ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড়ালে মশা সংক্রমিত হয়। এটি সরাসরি এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির মধ্যে ছড়াতে পারে না। সরাসরি মশার মাধ্যমেই ছড়ায়। সেজন্যই আক্রান্ত ব্যক্তিতে মশারির নীচে রাখা জরুরি।
লক্ষণগুলি যা সাধারণত সংক্রমণের ৪ থেকে ৬ দিন পরে শুরু হয় এবং ১০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এতে যে লক্ষণগুলো দেখা যায় তা হলো- হঠাৎ অতিরিক্ত জ্বর অর্থাৎ ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা এর উপরে, তীব্র মাথাব্যথা, চোখের পিছনের দিকে ব্যথা, গুরুতর জয়েন্ট এবং পেশী ব্যথা, ক্লান্তি-অবসন্নতা, বমি বমি ভাব।
কখনো কখনো বমি হওয়া, ত্বকে র্যাশ বা ফুসকুড়িও দেখা দেয়। এ র্যাশ বা ফুসকুড়ি বেশিরভাগ জ্বর শুরুর দুই থেকে পাঁচ দিন পরে দেখা যায়। কখনো হালকা রক্তপাত, যেমন নাক দিয়ে রক্ত পড়া, মাড়ি থেকেও রক্ত পড়তে পারে।
লক্ষণগুলি খুব বেশি প্রকাশ না পেলে ফ্লু বা অন্য ভাইরাল সংক্রমণ ভেবে ভুল হতে পারে। ছোট শিশু থেকে প্রাপ্ত বয়স্করাও আক্রান্ত হতে পারে। এতে কিছু কিছু সমস্যা খুবই গুরুতর হতে পারে। যেমন ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর। এটি একটি বড় ধরণের জটিলতা। যা লিম্ফ এবং রক্তনালীর ক্ষতি হয়ে নাক এবং মাড়ি থেকে রক্তপাত হতে পারে। এর সাথে লিভার বড় হওয়া এবং রক্ত সংবহনতন্ত্রের জটিলতাও রয়েছে। এ ধরণের লক্ষণগুলিতে ব্যাপক রক্তপাত, শক এমনকি মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হতে পারে। এ অবস্থাকে বলা হয় ডেঙ্গু শক সিনড্রোম (ডিএসএস)।
দুর্বল ইমিউন সিস্টেমের লোকদের, পাশাপাশি যাদের দ্বিতীয় বা পরবর্তী ডেঙ্গু সংক্রমণ রয়েছে তাদের ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার হওয়ার ঝুঁকি বেশি বলে মনে করা হয়।
ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধ
রোগ প্রতিরোধের সর্বোত্তম উপায় হল সংক্রামিত মশার কামড় প্রতিরোধ করা। বিশেষ করে যদি কেউ কোন গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে থাকেন বা ভ্রমণ করেন। এ অবস্থায় নিজেকে রক্ষা করা এবং মশার উৎপাদন কম রাখার প্রচেষ্টা করা জরুরি।
নিজেদের সুরক্ষার জন্য করণীয়:
- ঘরে মশা তাড়ানোর ওষুধ ব্যবহার করুন।
- বাইরে গেলে, লম্বা হাতা শার্ট এবং মোজা পরা লম্বা প্যান্ট পরুন।
- জানালা এবং দরজার পর্দা নিরাপদ এবং ছিদ্রমুক্ত যেনো থাকে সেদিকে খেয়াল করুন। ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করুন।
- ডেঙ্গুর লক্ষণ প্রকাশ পেলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন। কারণ সমস্যা মারাত্নক হলে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে যাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
- মশার সংখ্যা কমাতে যেসব জায়গাগুলোতে মশা ডিম পাড়ে সেগুলো ধ্বংস করতে হবে। যেমন: পুরনো টায়ার, ক্যান বা ফুলের টব যেখানে বৃষ্টির পানি জমে থাকে। ঘরের বাইরে পোষা পশু পাখির পানি পানের স্থানগুলোতে যেখানে পানি জমে থাকে সেখান নিয়মিত পানি পরিবর্তন করুন।
- যদি বাড়ির কারো ডেঙ্গু জ্বর হয়, তাহলে নিজেকে ও পরিবারের অন্যান্যদের ডেঙ্গুর কবল থেকে রক্ষার জন্য আক্রান্ত ব্যক্তিকে মশারির ভেতর রাখুন।
ডেঙ্গুজ্বরে খাদ্য ও পুষ্টির দিকে বেশি যত্নশীল হতে হবে। প্রতি ডিগ্রী জ্বরে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে ক্যালরি চাহিদা বেড়ে যায়। পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিও জরুরি। প্লাটিলেটস (platelets) কমে যাওয়ায় প্রচুর পানিয় এবং নির্ধারিত ফল ও সবজি গ্রহণ করা প্রয়োজন।
ফল
গ্রহনীয় খাবার– পেঁপে, আনারস, স্ট্রবেরি, পেয়ারা, কিউই, ডালিম, আপেল, নাশপাতি, কলা, তরমুজ ইত্যাদি।
বর্জনীয় খাবার– সাইট্রাস ফল, প্যাকেটজাত ফল।
সবজি
গ্রহনীয় খাবার– পালং শাক, করলা, আলু, বাঁধাকপি, কুমড়া, গোলমরিচ, শালগম, মুলা, ব্রকলি, বিটরুট, মাশরুম, টমেটো, শসা, পেঁয়াজ, মেথি পাতা, গাজর, কলা, ধনিয়া পাতা ইত্যাদি।
বর্জনীয় খাবার– লাল ও সবুজ মরিচ, হিমায়িত সবজি, ক্যাপসিকাম, ঢেরষ।
শস্যদানা
গ্রহনীয় খাবার– গম, চাল, ওটমিল, বাজরা, কুইনো, সুজি, বার্লি ইত্যাদি।
বর্জনীয় খাবার– রিফাইন্ড আটা-ময়দা
ডাল বা গুল্মজাতিয়
গ্রহনীয় খাবার– ভাঙা ডাল।
বর্জনীয় খাবার– শুকনো এবং হিমায়িত ডাল
মশলা
গ্রহনীয় খাবার– হলুদ, জিরা, মৌরি, পুদিনা পাতা, ধনিয়া, মেথি, লবণ সীমিত পরিমাণে।
বর্জনীয় খাবার– লাল মরিচের গুঁড়া, লবঙ্গ।
তেল
গ্রহনীয় খাবার– অলিভ অয়েল, ফ্লেক্সসিড অয়েল, সরিষার তেল, সয়াবিন তেল।
বর্জনীয় খাবার– নারকেল তেল, পাম তেল।
বাদাম
গ্রহনীয় খাবার– কাঠবাদাম, কিসমিস, আখরোট।
বর্জনীয় খাবার– চিনাবাদাম, কাজুবাদাম।
দুধ বা দুগ্ধজাত খাদ্য
গ্রহনীয় খাবার– ছাগলের দুধ, গরুর দুধের ঘি।
বর্জনীয় খাবার- ননিযুক্ত দুধ এবং ক্রিম, চর্বিযুক্ত দই, ক্রিম পনির, দই, বাটার মিল্ক, কনডেন্সড মিল্ক, মাখন।
পানীয়
গ্রহনীয় খাবার– ডাবের পানি, ভেষজ চা, গাজরের জুস, ঘরে তৈরি সবজির স্যুপ, শসার জুস, আনারসের জুস, কিউই জুস, ডালিমের রস, পেয়ারার রস, পেঁপের পাতার রস, আমলার রস, অ্যালোভেরার জুস।
বর্জনীয় খাবার- কফি, চা, অ্যালকোহল, কার্বনেটেড ড্রিংক্স, টিনজাত ফলের জুস, চুনের পানি।